গত বছরও ডেঙ্গুর প্রকোপে নাজেহাল হয়ে উঠেছিল নগরবাসী।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে কারণ বসন্তের প্রথম দিক থেকেই মশার উপদ্রব খুব বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দলের আলাদা দুটি জরিপে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিভিন্ন ওয়ার্ডে আশঙ্কাজনকহারে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিন জনকে শনাক্ত করা হয় এবং এরপর নতুন করে আর কোনো আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। তবে, অনেক মানুষকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে, বিশেষ করে যারা বিদেশ ফেরত।
গত বছর ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল বাংলাদেশে। ডেঙ্গুর কারণে গত বছর প্রাণহানি হয় ১৭৯ জনের এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে শনিবার (১৪ মার্চ) সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে কমপক্ষে ২৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এডিস মশার বিস্তার নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে এক সমীক্ষার সময় গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পতঙ্গবিজ্ঞানী অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, গত বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং চলতি বছরের একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৯ জন, যা রাজধানীতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ার ঈঙ্গিত দেয়।
তিনি বলেন, যেহেতু এ মাসের শুরু থেকেই হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
কবিরুল বাশার আরও বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব হ্রাস করতে এর প্রজনন ক্ষেত্রগুলো এই মাসের মধ্যেই ধ্বংস করার উদ্যোগ নিতে হবে দুই সিটি করপোরেশনকে।
‘জুন থেকেই পুরোদমে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যাবে এবং এ সময়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকবে, যদি এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস না করা হয়’, যোগ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: দেশে নতুন ২ করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন, বিভিন্ন নির্মাণস্থল, বাস টার্মিনাল, থানা (যেখানে জব্দ করা অনেক যানবাহন খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে), বিভিন্ন হাসপাতালের সামনের ও পেছনের অংশ এবং বিভিন্ন সরকারি স্থাপনাগুলোই হলো এডিস মশার মূল প্রজনন উৎস।
গত তিন মাসে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অভিযান নেই উল্লেখ করে কবিরুল বলেন, মশা নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের এখনই সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের উচিত জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং এডিস মশার প্রজনন উৎস চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
জাবি অধ্যাপক বলেন, এডিস মশা নিধন এবং তাদের প্রজনন ক্ষেত্রগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করার জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীটনাশক স্প্রে করার জন্য শহর কর্তৃপক্ষের উচিত ক্রাশ প্রকল্প গ্রহণ করা।
এর আগে করা সমীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে কবিরুল জানান, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকটি এলাকায় মশা পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্সে ২৫ শতাংশেরও বেশি এবং ৫০০ মিলিলিটার পানিতে ২শ’রও বেশি এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে, যা এডিস মশার বিশাল ঘনত্বই প্রকাশ করে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি করা নিজেদের এক সমীক্ষায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ শতাংশ ওয়ার্ডে এডিস মশার অবস্থা ঝূঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, এডিস ব্রুটো সূচকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১, ১২, ১৬, ২৮, ৩১ নম্বর ওয়ার্ড এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ ও ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস ব্রুটো সূচক ২০ পয়েন্টেরও বেশি। আর ডিএনসিসির ১২ নং ওয়ার্ডে এই সূচক ৩০ এর কাছাকাছি।
জরিপের ফলাফল পর্যালোচনা করে আবুল কালাম বলেন, এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো এখনই ধ্বংস করা না হলে, এ বছর ভয়াবহ আকারে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নগরবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি এবং আশেপাশের জায়গাগুলো পরিস্কার রাখতে হবে, যাতে সেখানে পানি না জমতে পারে।
ঝূঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে মশা নিধন ও সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন।
তিনি জানান, জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বর্ষাকালে এডিস মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে কাজ অব্যহত রাখা হয়েছে।
মামুন জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে ডিএনসিসির ৫ ওয়ার্ডকে সবচেয়ে ঝূঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এডিস মশার প্রজনন উৎস ধ্বংস করতে ওইসব এলাকায় বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
এডিস মশার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে নগরবাসীর সহযোগীতাও প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
সাধারণ মানুষকে নিজেদের বাড়িঘর, ভবন এবং সংলগ্ন এলাকা পরিস্কার রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে সেখানে বর্জ্য ফেলবেন না এবং কোথাও পানি জমতে দেবেন না। ডাবের খোসা, খোলা বোতল, প্লাস্টিকের হাঁড়ি, ভাঙা পাত্র এবং পরিত্যক্ত ফুলের টবগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখবেন না।
মশাবাহিত রোগ ছাড়াও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরী বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আহমেদ বলেন, তাদের ৫, ৬, ১১, ১৭, ৩৭ ও ৪২ নং ওয়ার্ডকে ঝূঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
এডিস মশার প্রজনন উৎস ধ্বংস করতে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএসসিসি একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে বলে জানান শরিফ আহমেদ।